পাঁচ বছরের বাচ্চা হোক বা পঞ্চাশের প্রৌঢ়, আজকাল যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, দেখবেন বলছে— ‘মারাত্মক স্ট্রেস-এ রয়েছি। কিচ্ছু ভাবতে পারছি না!’ আর যুবক-যুবতীরা সবসময়েই স্ট্রেস-এ থাকেন!
আচ্ছা, কখনও নিজেকে প্রশ্ন করেছেন এত ‘স্ট্রেস’ তৈরি হয় কোথা থেকে? খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্ট্রেস তৈরি হয় ‘অতীত’ আর ‘ভবিষ্যতে’র চিন্তা থেকে।
মন নিয়ে গবেষণা বলছে, অতীত নিয়ে বেশি চিন্তা আমাদের মধ্যে অপ্রাপ্তির আর অতৃপ্তি অনুভব ডেকে আনে। অন্যদিকে অজানা ভবিষ্যতের চিন্তা ডেকে আনে শঙ্কা!
অতৃপ্তি, অপ্রাপ্তি, শঙ্কা মিলে তৈরি হয় দুশ্চিন্তা! স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তা একটা গরলপূর্ণ নদীর মতো। আপনি হাবুডুবু খাবেন, অথচ শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাবেন না। কারণ তখন মনের মধ্যে তৈরি হবে প্রবল অস্থিরতা! শুধু মনে হবে— একটু শান্ত হয়ে মনোযোগ দিয়ে ভাবলেই পাওয়া যাবে সমাধানসূত্র! কিন্তু মনকে শীতল করবেন কীভাবে? আর কীভাবেই বা বাড়ানো যাবে মনঃসংযোগের ক্ষমতা?
জানলে অবাক হবেন, মস্তিষ্ককে শান্ত করতে পারলেই ব্রেনের যে অংশগুলি যুক্তি দিয়ে ভাবতে পারে বা স্মৃতি ধরে রাখতে পারে সেগুলি সজাগ হয়ে ওঠে। ফলে ঠান্ডা হয়ে ভাবতে পারা যায়। বেরিয়ে আসে যে কোনও সমস্যার সমাধান সূত্র!
মনকে শান্ত আর শীতল রাখার জন্য খুব সুন্দর একটি ব্যায়াম রয়েছে। এই ব্যায়ামের নাম মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ!
প্রশ্ন হল মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ কী? সহজভাবে বললে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অবলোকন করাই হল মাইন্ডফুলনেস এক্সারসাইজ!
অর্থাৎ সামনের গাছটি থেকে যে পাতাটি ঝরে পড়ল সেটির রং, যে বাতাস বয়ে যাচ্ছে তার শীতলতা অনুভব করাই হল মাইন্ডফুলনেস! আবার টেবিলে রাখা জলের গ্লাসের তলা থেকে উঠে আসা প্রতিটি বুদ্বুদকেও খেয়াল করার পদ্ধতি হল মাইন্ডফুলনেস! এই পদ্ধতি একধরনের নিরন্তর অভ্যেসের মতো!
প্রশ্ন হল কেন জীবনের ‘মহূর্তগুলি’কে অবলোকন করার কথা বলছেন মনোবিজ্ঞানীরা? কারণ আগেই বলেছি, অতীত নিয়ে ভাবনা ডেকে আনে অতৃপ্তি আর অপ্রাপ্তির অনুভব। অন্যদিকে অজানা ভবিষ্যত তৈরি করে তীব্র আশঙ্কা। বরং আমরা অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করি বর্তমানে! এই যে শ্বাস ফেললাম, পলক পড়ল, সামনে একটা পাখি উড়ে গেল, অলসভাবে রাস্তায় রোদ শুয়ে আছে— এই তাৎক্ষণিক মুহূর্তগুলির দিকে নজর দেওয়াই আমাদের মধ্যে নিরাপত্তার বোধ তৈরি করে!
মুশকিল হল, আমরা চাইলেও সবসময় মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চা করতে পারব না। তাই রোজকার কাজের মধ্যেই একটা সময় বের করতে হবে। অতএবআমরা যদি প্রতিদিন খাবার খাওয়ার সময়গুলিতে মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চা করি তাহলেই অনেকটা কাজ হবে।
খাবার খেতে খেতে মাইন্ডফুলনেস চর্চা
খাবার খেতে বসার মুহূর্ত থেকেই শুরু করুন মাইন্ডফুলনেসের চর্চা।
প্রথমে দেখুন খাবার খাওয়ার প্লেটের রং। তারপর দেখুন পাতে কী কী দেওয়া হল! ভাত, ডাল, তরকারি, শাক!
এভাবে পূর্ণ মনোনিবেশ করুন খাবারের পাতের প্রতি। খেয়াল করুন ঠিক কোন তরকারি দিয়ে ভাত মাখাচ্ছেন। তারপর সযত্নে সেই গ্রাস নিজের মুখে তুলে দিন। জিভের স্বাদকোরক গুলির সাহায্যে বোঝার চেষ্টা করুন ঠিক কোন উপাদান ও মশলা ব্যবহার করা হয়েছে রান্নায়! মুখের বিভিন্ন অংশে খাদ্য পৌঁছনোর পর কীভাবে বিভিন্ন ধরনের স্বাদ বয়ে নিয়ে আসছে খেয়াল করে দেখুন তাও! একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন আপনি একটুকরো কেক খাচ্ছেন। কেকটির রং কেমন? স্বাদ কেমন? কী কী উপাদান ব্যবহার হয়েছে তাতে? বোঝার চেষ্টা করুন ধীরে ধীরে। মজার ব্যাপার হল, খাবার খেতে খেতে এভাবে মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চার সময়েও মন কিন্তু ফের অতীতে বা ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুবে যেতে পারে! সেটা বুঝতে পারলে নিজেকে কিন্তু দোষারোপ বা শাসন করা চলবে না! মাইন্ডফুলনেস-এর মূল শর্তই হল, বিচার করা যাবে না, করা যাবে না সমালোচনা!
কারণ যখনই আপনি ধরতে পারবেন, খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ বোঝার সময় আপনার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তখনই বুঝতে হবে আপনি সফল হচ্ছেন! মনের এই বিচলতা বোঝার মহূর্তই হল মাইন্ডফুলনেস-এর মূল সন্ধিক্ষণ বা টার্নিং পয়েন্ট! অর্থাৎ আপনি ক্রমশ সচেতন হচ্ছেন! অতএব আপনি আবার মনকে বাঁধতে শুরু করুন। পুনরায় মনোনিবেশ করুন খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধে!
মাইন্ডফুলনেস চর্চার লাভ
অসংখ্য গবেষণা হয়েছে মাইন্ডফুলনেসের লাভ নিয়ে। তবে মূল তিনটি লাভ নিয়ে কথা বলা দরকার।
১) সবধরনের আবেগের ঘনঘটার কেন্দ্রবিন্দু হল মস্তিষ্কের ‘অ্যামিগডালা’ নামে অংশ! এই কেন্দ্র উত্তেজিত হলেই স্ট্রেস ও শঙ্কা বাড়ে! সর্বক্ষণ স্ট্রেস-এ থাকলে এই কেন্দ্র অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তি বিসর্জন দিয়ে আবেগের স্রোতে ভাসতে থাকেন মানুষ। দেখা গিয়েছে ধারাবাহিকভাবে মাইন্ডফুলনেস চর্চা করলে ব্রেনের ‘অ্যামিগডালা’ বা শঙ্কা জাগানোর কেন্দ্রটি ক্রমশ আকারে ছোট হতে থাকে! কমতে থাকে অযৌক্তিক আবেগের স্রোত।
২) ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের বিচক্ষণ হতে সাহায্য করে। তৈরি করে যুক্তি বোধ। আবেগ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিস্থিতি বিচার করতে সাহায্য করে ব্রেনের এই অংশ! বলা ভালো, মাস্টারমশাইয়ের মতোই কোনটি ঠিক এবং কোনটি ভুল তা বুঝতে শেখায় প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স।
মন বিক্ষিপ্ত থাকলে মাস্টারমশাই সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ধারাবাহিকভাবে মাইন্ডফুলনেস অভ্যেস করলে প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের ঘনত্ব বাড়ে! ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, বিচার ক্ষমতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ে।
৩) মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অংশটি স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। দেখা গিয়েছে, হিপ্পোক্যাম্পাসের ঘনত্ব কমে যাওয়া স্ট্রেসের সঙ্গে সম্পর্কিত! নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস অভ্যেস করলে হিপ্পোক্যাম্পাস নতুন করে সজীব ও ঘন হয়ে ওঠে। ফলে হিপ্পোক্যাম্পাস ভবিষ্যতে নতুন করে কিছু শেখা ও মনে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ সাহায্য করে। কমতে থাকে স্ট্রেস!
তাহলে আর দেরি নয়। আজ থেকেই খাবার খাওয়ার সময় শুরু করুন মাইন্ডফুলনেস-এর চর্চা! নিজেকে তৈরি করুন একজন সফল মানুষ।
পরামর্শে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ দেবাঞ্জন পান।
অনুলিখন: সুপ্রিয় নায়েক